https://www.facebook.com/najmuz
লিনাক্সের ইতিহাস
লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস জন্ম ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে, নোবেল প্রাইজ বিজয়ী আমেরিকান বিজ্ঞানী কেমিস্ট “লিনুস পলিং” এর নামানুসারে তার না রাখা হয়। ছোটবেলা থেকে খুব একটা কারো সাথে মিশতোনা, খেলাধুলাতেও কোন উৎসাহ ছিলনা তার। বাবা অনেক চেষ্টা করে ছেলেকে সামাজিক করতে, কিন্তু তার পুরো চেষ্টাই বিফলে যায়। ডিজিটাল জগৎতের কোড লিখাই যেন ছিল ছেলের আসল আনন্দ। কেউ না চিন্তেপারলেও ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত হেলসিংক ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যানের প্রফেসর নাতিকে ঠিকই চিনেছিলেন।
তাই তিনি নাতিকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন “কমোডোর ভিআইসি টুয়েন্টি। জিবনের প্রথম Personal Computer পেয়ে লিনুস খুশি হয়েছিলেন ঠিকি কিন্তু কম্পিউটারের সাথে থাকা সামান্য কিছু প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করার পর কিছুদিনের মাঝেই সেই খুশি হারিয়ে গেল। এরপর কোন উপায় না দেখে নিজেই বসে গেলেন প্রোগ্রাম লিখতে।
লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস
মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণা :--
রিচার্ড স্টলম্যান ছিলেন একজন দক্ষ প্রোগ্রামার, ওপেন সোস বা মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণা টা প্রথমে রিচার্ড স্টলম্যানের কাজ থেকেই আসে। তিনি এমআইটির আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এই লোকটির জন্যই আজকে পৃথিবীতে মুক্ত সফটওয়্যারের জোয়ার শুরু হয়েছে। আশির দশকের প্রথমভাগে সেসব নামকরা কমার্শিয়াল সফটওয়্যার কোম্পানি ছিল তারা মোটা টাকা দিয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবের ব্রিলিয়ান্ট প্রোগ্রামারদের হাত করতে শুরু করল। শুধু তাই না তারা সেই সাথে তারা তাদের সফটওয়্যারের সোর্স কোড ও গোপন করা শুরু করলো। এক কথায় বলতে গেলে আপনার আমার মতো সাধারন মানুষদের জানার কোন অধিকারই নাই কিভাবে কোন সফটওয়্যার তৈরি করা হল। টাকা দিয়ে সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সাধারন মানুষ। তার মানে আপনার যদি সফটওয়্যারটি কিনার মতো টাকা থাকে তাহলে আপনি সফটওয়্যারটি কিনে ব্যবহার করতে পারবেন। আর যদি আপনার সফটওয়্যারটি কেনার সামর্থ্য না থাকে তাহলে সফটওয়্যার আপনার জন্য না।
রিচার্ড স্টলম্যান
কিন্তু সেই সমায়ে রিচার্ড স্টলম্যানের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারেই পুরোপুরি অন্য রকম। রিচার্ড স্টলম্যানের মতে এইসব বাধাধরা নিয়ম দিয়ে সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনাকে আটকে ফেলা পুরোপুরি অনুচিত ও অনৈতিক। সফটওয়্যারের স্বার্থেই একে কোন নিয়মনীতি দিয়ে আটকে ফেলা উচিত না। তার ধারনা মতে সফটওয়্যার হতে হবে সবার জন্য মুক্ত, এতে করে সফটওয়্যারকে যে কেউ তার নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারবে, যার ফলে সফটওয়্যারের উন্নয়নও দ্রুত হবে। সেই লক্ষ্যেই রিচার্ড স্টলম্যান মুক্ত সফটওয়্যারের আন্দোলন শুরু করলেন।
“গ্নু” (GNU) প্রকল্প প্রতিষ্ঠা :--
পুরোপুরি বিনামূল্যের সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিক্স-সদৃশ অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালে রিচার্ড স্টলম্যান তাদের সমমনাদের নিয়ে গড়ে তুললেন সংগঠন, নাম দিলেন “গ্নু” (GNU) প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু করলেন মুক্ত সফটওয়্যার লেখার কাজ। কিন্তু এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম। কিন্তু সেজন্য দরকার প্রয়োজনীয় আরো সফটওয়্যার, বিশেষ করে একটা কম্পাইলার। সে লক্ষ্যে স্টলম্যান শুরু করলেন সি কম্পাইলার লেখার কাজ। তার কিংবদন্তিতূল্য প্রোগ্রামিং দক্ষতায় অল্প দিনেই তিনি শেষ করে ফেললেন কম্পাইলার লেখার কাজ, নাম দিলেন গ্নু সি কম্পাইলার বা জিসিসি (GCC)। “গ্নু” (GNU) এই অপারেটিং সিস্টেমের যে সমস্ত দরকারী উপাদান প্রয়োজন ছিল তার প্রায় সবগুলো উপাদান বানাতে বা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় ৯০-য়ের দশকের শুরুর দিকেই। একটি কম্পাইলার ছাড়াও উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন কোড, টেক্সট সম্পাদক (টেক্সট এডিটর), লাইব্রেরি, এছাড়াও ইউনিক্স-সদৃশ খোলস (শেল), এবং প্রয়জনীয় আরও অন্যান্য সফটওয়্যার। জিসিসি (GCC) এখনও অন্যতম কার্যকরি একটা কম্পাইলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরপর গ্নু হাত দিল অপারেটিং সিস্টেম লিখার কাজে। যেকোন অপারেটিং সিস্টেমের প্রান হচ্ছে তার কার্নেল। কার্নেলের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে যে কোন অপারেটিং সিস্টেম।
“গ্নু” (GNU)
১৯৯০ সালে “গ্নু” (GNU) প্রকল্প তাদের নিজস্ব কার্নেল গ্নু হার্ড (HURD) এর ওপর কাজ শুরু করে। হার্ড-এর প্রাথমিক পরিকল্পক ছিলেন টমাস বুশনেলের কথানুযায়ী তারা বিএসডি ৪.৪-লাইট কার্নেলটি তাদের কাজের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু বার্কলির প্রোগ্রামারদের মধ্যে সহযোগিতার ঘাটতি দেখে স্টলম্যান হার্ড প্রকল্পের জন্য মাখ মাইক্রোকার্নেল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরে দেখা যায় এটির ব্যবহার আশাতীতভাবে কষ্টসাধ্য, ফলে হার্ডের উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে এগোতে থাকে। মুক্ত সফটওয়্যারের পুরো আন্দোলনই যে থেমে যেতে থাকে।
যে ভাবে লিনাক্সের জন্ম :--
১৯৯১ সালে যখন লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস ইউনিভার্সিটি অফ হেলসিংকি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিনিক্স নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। মিনিক্স ছিল ইউনিক্সের ছোটখাট একটা ক্লোন, তবে পুরোপুরি ক্লোন নয়। ডাচ প্রফেসর এন্ড্রু টানেনবমের লেখা ইউনিক্সের মত একটা অপারেটিং সিস্টেম ছিল মিনিক্স। প্রফেসর সাহেব তার ছাত্রদের অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে ক্লাশ নেবার সময় অপারেটিং সিস্টেমের ভিতরের খুটিনাটি বুঝাতে মিনিক্সকে ব্যবহার করতেন। তবে মিনিক্সের কোড কিছুটা উন্মুক্ত ছিল। সেসময় যে কেউ প্রফেসর টানেনবমের লেখা “অপারেটিং সিস্টেমঃ ডিজাইন এ্যান্ড ইম্পলিমেন্টেশন” বইটা কিনলেই সাথে করে মিনিক্সের ১২০০০ লাইনের কোডটা পেত। যদিও পুরো কোড উন্মুক্ত নয় তারপরও সেই সময় কোন অপারেটিং সিস্টেমের আংশিক কোড পাওয়াটাও ছিল ভাগ্যের ব্যপার। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা ছিল, সেটা হল মিনিক্সের কোডকে নিজের ইচ্ছেমত পাল্টানোর লাইসেন্স ছিলনা। মিনিক্সে কোন পুর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেম ছিল না, এটি ছিল ছাত্রদের শিখানোর একটা উপকরনমাত্র।
সেইসময় লিনুস আইবিএমের ইন্টেল ৩৮৬ প্রসেসরের একটা পার্সনাল কম্পিউটার কিনল। এই প্রেসেসরটি ছিল ইন্টেলের আগের প্রসেসরগুলোর তুলনায় অত্যধিক উন্নত। সেসময় আইবিএমের সাথে পাওয়া যেত এমএসডস অপারেটিং সিস্টেম। এমএসডস ব্যবহার করে লিনুস পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ল, কারন ইন্টেলের ৩৮৬ প্রসেসরকে পুরোপুরি ব্যবহার করার ক্ষমতা সেটার ছিলনা। লিনুস চাচ্ছিল আরো ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে। এর অন্য কারন অবশ্য ছিল সে তার ভার্সিটিতে ইউনিক্স ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তাই নিজের পিসিতে একই অপারেটিং সিস্টেম থাকলে কাজ করতে সুবিধা। কিন্তু ইউনিক্স পাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো, কারণ যখন লিনুস দেখলো যে ইউনিক্সের দাম ৫০০০ মার্কিন ডলার! যাই হোক কি আর করার লিনুস অনেক চিন্তাভাবনা করে সেই মিনিক্সেটা কিনে ফেললো। কিন্তু এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে টের পেলো যে এটাও তার চাহিদা পূরণের জন্য উপযুক্ত না।
এবার লিনুস কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাই দুম করেই এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো লিনুস, “নিজেই একটা অপারেটিং সিস্টেম বানাবে” তাও আবার একদম শূন্য থেকে, মিনিক্স আর ইউনিক্সের আদলে, পুরোপুরি নতুন একটা অপারেটিং সিস্টেম! এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে কি বুঝতে পেরেছিল যে তার এই স্বিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তার আইবিএমের পিসিকেই পাল্টে দেবেনা বরং তার জীবন এবং পুরো পৃথিবীকেও পাল্টে দেবে! মনে হয় না।
১৯৯১ এপ্রিলে লিনুস তার অপারেটিং সিস্টেমের কাজ শুরু করে। তিনি টেক্সটবেজড ইউজার ইন্টারফেসের করার জন্য গ্নু ব্যাশ শেল আর কম্পাইলিং এর জন্য রিচার্ড স্টলম্যানের বানানো গ্নু সি কম্পাইলার (GCC) যুক্ত করে মোটামুটি একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলল লিনুস।
লিনুস চাইলেন মিনিক্স ইউজার গ্রুপের সবাইকে তার তৈরী নতুন অপারেটিং সিস্টেমের কথা জানাতে। মনে ভয় ছিল শুনে হয়তো সবাই হাসাহাসি করবে, আবার আশাও ছিল হয়তো কয়েকজন তাকে এ ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারে। দুরুদুরু মনেই তাই সে নিচের ঐতিহাসিক ইমেইলটা গ্রুপে পোস্ট করে ফেলল
এই বিখ্যাত মেইলটা পড়ে কিন্তু বোঝাতেই পারছেন যে লিনুস নিজেও কল্পনা করতে পারে নাই যে তার শখের বশে বানানো অপারেটিং সিস্টেম পৃথিবীতে বিশাল একটা পরিবর্তন আনবে। ঐ বছরেরই ১৭ই সেপ্টেম্বর লিনুস আর অপারেটিং সিস্টেমের প্রথম ভার্সন ০.০১ বের করে। ধীরে ধীরে অন্যরা জড়ো হতে থাকে। তারা ওএসটি ডাউনলোড করে নিজের সুবিধামত পরীক্ষা-পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে পরিবর্তিত ভার্সনটি পাঠাতে থাকে লিনুসকে। গড়ে উঠতে থাকে লিনুসের নতুন অপারেটিং সিস্টেম। ৫ই অক্টোবর বের হল প্রথম অফিসিয়াল রিলিজ ভার্সন ০.০২। সংগে লিনুসের তরফ থেকে আরেকটি এরপর কয়েক সপ্তাহের মাঝে বের হল ভার্সন ০.০৩। ঐ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বের হল ভার্সন ০.১০। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিনুস কে, এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে লিনাক্স।
লিনাক্সের নামকরণ :--
“লিনাক্স” নামটি কিন্ত লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস দেওয়া নয়। লিনাক্সের নামকরণের কৃতিত্ব এ্যারি লেমকের। লিনুসের খুব ইচ্ছে ছিল তার অপারেটিং সিস্টেমের নাম হবে “ফ্রিক্স” (FREAKS) যেটা কিনা “Free”, “Freak” আর “Unix” শব্দ তিনটার মিলিত একটা রূপ। কিন্তু নামটা পছন্দ হয়নি এ্যারি লেম্কের। এ্যারি লেম্কে ছিল হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির এফটিপি সার্ভারের এডমিনিস্ট্রেটর এবং লিনুসের বন্ধু ও সহকর্মী। এফটিপি সার্ভার দিয়ে খুব সহজেই যেকোন ফাইল সবার সাথে শেয়ার করা যায়। লিনুস যখন তার অপারেটিং সিস্টেম প্রকল্পটি এই সার্ভারটিতে রক্ষা করার জন্য লেমকে-কে দেন, এ্যারি লেমক তখন তা একটি ডিরেক্টরিতে রাখেন ও ডিরেক্টরিটির নাম দেন “লিনাক্স”। এ্যারিই প্রথম লিনুসকে বুদ্ধি দিল যে নতুন ওএসের সোর্সকোডকে এফটিপি সার্ভারে শেয়ার করতে, যাতে করে পৃথিবীর সবার জন্যই এর কোডটা উন্মুক্ত থাকে যাতে যে কেউ ইচ্ছে করলে সেটা নামিয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। সে “লিনাক্স” নামের একটি ফোল্ডারে এফটিপি সার্ভারে সেই কোডগুলো রেখে দিলেন। সেই থেকে নাম হয়ে গেল “লিনাক্স”। তাহলে এ্যারি লেমকের। এর মাথায় লিনাক্স নামটি কিভাবে আসল, সহজ ব্যাপার “Linus’s Unix” থেকেই এ্যারির মাথায় লিনাক্স নামটা চলে আসে। আসল নাম হারিয়ে লিনাক্স এখন যে নামে পরিচিত সেটা আসলে তার ডাউনলোড করার জন্য রাখা ফোল্ডারের নাম।
লিনাক্সের ইতিহাস
লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস জন্ম ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে, নোবেল প্রাইজ বিজয়ী আমেরিকান বিজ্ঞানী কেমিস্ট “লিনুস পলিং” এর নামানুসারে তার না রাখা হয়। ছোটবেলা থেকে খুব একটা কারো সাথে মিশতোনা, খেলাধুলাতেও কোন উৎসাহ ছিলনা তার। বাবা অনেক চেষ্টা করে ছেলেকে সামাজিক করতে, কিন্তু তার পুরো চেষ্টাই বিফলে যায়। ডিজিটাল জগৎতের কোড লিখাই যেন ছিল ছেলের আসল আনন্দ। কেউ না চিন্তেপারলেও ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত হেলসিংক ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যানের প্রফেসর নাতিকে ঠিকই চিনেছিলেন।
তাই তিনি নাতিকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন “কমোডোর ভিআইসি টুয়েন্টি। জিবনের প্রথম Personal Computer পেয়ে লিনুস খুশি হয়েছিলেন ঠিকি কিন্তু কম্পিউটারের সাথে থাকা সামান্য কিছু প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করার পর কিছুদিনের মাঝেই সেই খুশি হারিয়ে গেল। এরপর কোন উপায় না দেখে নিজেই বসে গেলেন প্রোগ্রাম লিখতে।
লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস
মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণা :--
রিচার্ড স্টলম্যান ছিলেন একজন দক্ষ প্রোগ্রামার, ওপেন সোস বা মুক্ত সফটওয়্যারের ধারণা টা প্রথমে রিচার্ড স্টলম্যানের কাজ থেকেই আসে। তিনি এমআইটির আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এই লোকটির জন্যই আজকে পৃথিবীতে মুক্ত সফটওয়্যারের জোয়ার শুরু হয়েছে। আশির দশকের প্রথমভাগে সেসব নামকরা কমার্শিয়াল সফটওয়্যার কোম্পানি ছিল তারা মোটা টাকা দিয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবের ব্রিলিয়ান্ট প্রোগ্রামারদের হাত করতে শুরু করল। শুধু তাই না তারা সেই সাথে তারা তাদের সফটওয়্যারের সোর্স কোড ও গোপন করা শুরু করলো। এক কথায় বলতে গেলে আপনার আমার মতো সাধারন মানুষদের জানার কোন অধিকারই নাই কিভাবে কোন সফটওয়্যার তৈরি করা হল। টাকা দিয়ে সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সাধারন মানুষ। তার মানে আপনার যদি সফটওয়্যারটি কিনার মতো টাকা থাকে তাহলে আপনি সফটওয়্যারটি কিনে ব্যবহার করতে পারবেন। আর যদি আপনার সফটওয়্যারটি কেনার সামর্থ্য না থাকে তাহলে সফটওয়্যার আপনার জন্য না।
রিচার্ড স্টলম্যান
কিন্তু সেই সমায়ে রিচার্ড স্টলম্যানের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একেবারেই পুরোপুরি অন্য রকম। রিচার্ড স্টলম্যানের মতে এইসব বাধাধরা নিয়ম দিয়ে সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনাকে আটকে ফেলা পুরোপুরি অনুচিত ও অনৈতিক। সফটওয়্যারের স্বার্থেই একে কোন নিয়মনীতি দিয়ে আটকে ফেলা উচিত না। তার ধারনা মতে সফটওয়্যার হতে হবে সবার জন্য মুক্ত, এতে করে সফটওয়্যারকে যে কেউ তার নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারবে, যার ফলে সফটওয়্যারের উন্নয়নও দ্রুত হবে। সেই লক্ষ্যেই রিচার্ড স্টলম্যান মুক্ত সফটওয়্যারের আন্দোলন শুরু করলেন।
“গ্নু” (GNU) প্রকল্প প্রতিষ্ঠা :--
পুরোপুরি বিনামূল্যের সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিক্স-সদৃশ অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালে রিচার্ড স্টলম্যান তাদের সমমনাদের নিয়ে গড়ে তুললেন সংগঠন, নাম দিলেন “গ্নু” (GNU) প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু করলেন মুক্ত সফটওয়্যার লেখার কাজ। কিন্তু এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম। কিন্তু সেজন্য দরকার প্রয়োজনীয় আরো সফটওয়্যার, বিশেষ করে একটা কম্পাইলার। সে লক্ষ্যে স্টলম্যান শুরু করলেন সি কম্পাইলার লেখার কাজ। তার কিংবদন্তিতূল্য প্রোগ্রামিং দক্ষতায় অল্প দিনেই তিনি শেষ করে ফেললেন কম্পাইলার লেখার কাজ, নাম দিলেন গ্নু সি কম্পাইলার বা জিসিসি (GCC)। “গ্নু” (GNU) এই অপারেটিং সিস্টেমের যে সমস্ত দরকারী উপাদান প্রয়োজন ছিল তার প্রায় সবগুলো উপাদান বানাতে বা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় ৯০-য়ের দশকের শুরুর দিকেই। একটি কম্পাইলার ছাড়াও উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন কোড, টেক্সট সম্পাদক (টেক্সট এডিটর), লাইব্রেরি, এছাড়াও ইউনিক্স-সদৃশ খোলস (শেল), এবং প্রয়জনীয় আরও অন্যান্য সফটওয়্যার। জিসিসি (GCC) এখনও অন্যতম কার্যকরি একটা কম্পাইলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরপর গ্নু হাত দিল অপারেটিং সিস্টেম লিখার কাজে। যেকোন অপারেটিং সিস্টেমের প্রান হচ্ছে তার কার্নেল। কার্নেলের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে যে কোন অপারেটিং সিস্টেম।
“গ্নু” (GNU)
১৯৯০ সালে “গ্নু” (GNU) প্রকল্প তাদের নিজস্ব কার্নেল গ্নু হার্ড (HURD) এর ওপর কাজ শুরু করে। হার্ড-এর প্রাথমিক পরিকল্পক ছিলেন টমাস বুশনেলের কথানুযায়ী তারা বিএসডি ৪.৪-লাইট কার্নেলটি তাদের কাজের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু বার্কলির প্রোগ্রামারদের মধ্যে সহযোগিতার ঘাটতি দেখে স্টলম্যান হার্ড প্রকল্পের জন্য মাখ মাইক্রোকার্নেল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরে দেখা যায় এটির ব্যবহার আশাতীতভাবে কষ্টসাধ্য, ফলে হার্ডের উন্নয়নকাজ ধীরগতিতে এগোতে থাকে। মুক্ত সফটওয়্যারের পুরো আন্দোলনই যে থেমে যেতে থাকে।
যে ভাবে লিনাক্সের জন্ম :--
১৯৯১ সালে যখন লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস ইউনিভার্সিটি অফ হেলসিংকি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিনিক্স নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন। মিনিক্স ছিল ইউনিক্সের ছোটখাট একটা ক্লোন, তবে পুরোপুরি ক্লোন নয়। ডাচ প্রফেসর এন্ড্রু টানেনবমের লেখা ইউনিক্সের মত একটা অপারেটিং সিস্টেম ছিল মিনিক্স। প্রফেসর সাহেব তার ছাত্রদের অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে ক্লাশ নেবার সময় অপারেটিং সিস্টেমের ভিতরের খুটিনাটি বুঝাতে মিনিক্সকে ব্যবহার করতেন। তবে মিনিক্সের কোড কিছুটা উন্মুক্ত ছিল। সেসময় যে কেউ প্রফেসর টানেনবমের লেখা “অপারেটিং সিস্টেমঃ ডিজাইন এ্যান্ড ইম্পলিমেন্টেশন” বইটা কিনলেই সাথে করে মিনিক্সের ১২০০০ লাইনের কোডটা পেত। যদিও পুরো কোড উন্মুক্ত নয় তারপরও সেই সময় কোন অপারেটিং সিস্টেমের আংশিক কোড পাওয়াটাও ছিল ভাগ্যের ব্যপার। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা ছিল, সেটা হল মিনিক্সের কোডকে নিজের ইচ্ছেমত পাল্টানোর লাইসেন্স ছিলনা। মিনিক্সে কোন পুর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেম ছিল না, এটি ছিল ছাত্রদের শিখানোর একটা উপকরনমাত্র।
সেইসময় লিনুস আইবিএমের ইন্টেল ৩৮৬ প্রসেসরের একটা পার্সনাল কম্পিউটার কিনল। এই প্রেসেসরটি ছিল ইন্টেলের আগের প্রসেসরগুলোর তুলনায় অত্যধিক উন্নত। সেসময় আইবিএমের সাথে পাওয়া যেত এমএসডস অপারেটিং সিস্টেম। এমএসডস ব্যবহার করে লিনুস পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ল, কারন ইন্টেলের ৩৮৬ প্রসেসরকে পুরোপুরি ব্যবহার করার ক্ষমতা সেটার ছিলনা। লিনুস চাচ্ছিল আরো ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে। এর অন্য কারন অবশ্য ছিল সে তার ভার্সিটিতে ইউনিক্স ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তাই নিজের পিসিতে একই অপারেটিং সিস্টেম থাকলে কাজ করতে সুবিধা। কিন্তু ইউনিক্স পাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো, কারণ যখন লিনুস দেখলো যে ইউনিক্সের দাম ৫০০০ মার্কিন ডলার! যাই হোক কি আর করার লিনুস অনেক চিন্তাভাবনা করে সেই মিনিক্সেটা কিনে ফেললো। কিন্তু এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে টের পেলো যে এটাও তার চাহিদা পূরণের জন্য উপযুক্ত না।
এবার লিনুস কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাই দুম করেই এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো লিনুস, “নিজেই একটা অপারেটিং সিস্টেম বানাবে” তাও আবার একদম শূন্য থেকে, মিনিক্স আর ইউনিক্সের আদলে, পুরোপুরি নতুন একটা অপারেটিং সিস্টেম! এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে কি বুঝতে পেরেছিল যে তার এই স্বিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তার আইবিএমের পিসিকেই পাল্টে দেবেনা বরং তার জীবন এবং পুরো পৃথিবীকেও পাল্টে দেবে! মনে হয় না।
১৯৯১ এপ্রিলে লিনুস তার অপারেটিং সিস্টেমের কাজ শুরু করে। তিনি টেক্সটবেজড ইউজার ইন্টারফেসের করার জন্য গ্নু ব্যাশ শেল আর কম্পাইলিং এর জন্য রিচার্ড স্টলম্যানের বানানো গ্নু সি কম্পাইলার (GCC) যুক্ত করে মোটামুটি একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলল লিনুস।
লিনুস চাইলেন মিনিক্স ইউজার গ্রুপের সবাইকে তার তৈরী নতুন অপারেটিং সিস্টেমের কথা জানাতে। মনে ভয় ছিল শুনে হয়তো সবাই হাসাহাসি করবে, আবার আশাও ছিল হয়তো কয়েকজন তাকে এ ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারে। দুরুদুরু মনেই তাই সে নিচের ঐতিহাসিক ইমেইলটা গ্রুপে পোস্ট করে ফেলল
এই বিখ্যাত মেইলটা পড়ে কিন্তু বোঝাতেই পারছেন যে লিনুস নিজেও কল্পনা করতে পারে নাই যে তার শখের বশে বানানো অপারেটিং সিস্টেম পৃথিবীতে বিশাল একটা পরিবর্তন আনবে। ঐ বছরেরই ১৭ই সেপ্টেম্বর লিনুস আর অপারেটিং সিস্টেমের প্রথম ভার্সন ০.০১ বের করে। ধীরে ধীরে অন্যরা জড়ো হতে থাকে। তারা ওএসটি ডাউনলোড করে নিজের সুবিধামত পরীক্ষা-পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে পরিবর্তিত ভার্সনটি পাঠাতে থাকে লিনুসকে। গড়ে উঠতে থাকে লিনুসের নতুন অপারেটিং সিস্টেম। ৫ই অক্টোবর বের হল প্রথম অফিসিয়াল রিলিজ ভার্সন ০.০২। সংগে লিনুসের তরফ থেকে আরেকটি এরপর কয়েক সপ্তাহের মাঝে বের হল ভার্সন ০.০৩। ঐ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বের হল ভার্সন ০.১০। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিনুস কে, এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে লিনাক্স।
লিনাক্সের নামকরণ :--
“লিনাক্স” নামটি কিন্ত লিনুস বেনেডিক্ট টারভাল্ডস দেওয়া নয়। লিনাক্সের নামকরণের কৃতিত্ব এ্যারি লেমকের। লিনুসের খুব ইচ্ছে ছিল তার অপারেটিং সিস্টেমের নাম হবে “ফ্রিক্স” (FREAKS) যেটা কিনা “Free”, “Freak” আর “Unix” শব্দ তিনটার মিলিত একটা রূপ। কিন্তু নামটা পছন্দ হয়নি এ্যারি লেম্কের। এ্যারি লেম্কে ছিল হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির এফটিপি সার্ভারের এডমিনিস্ট্রেটর এবং লিনুসের বন্ধু ও সহকর্মী। এফটিপি সার্ভার দিয়ে খুব সহজেই যেকোন ফাইল সবার সাথে শেয়ার করা যায়। লিনুস যখন তার অপারেটিং সিস্টেম প্রকল্পটি এই সার্ভারটিতে রক্ষা করার জন্য লেমকে-কে দেন, এ্যারি লেমক তখন তা একটি ডিরেক্টরিতে রাখেন ও ডিরেক্টরিটির নাম দেন “লিনাক্স”। এ্যারিই প্রথম লিনুসকে বুদ্ধি দিল যে নতুন ওএসের সোর্সকোডকে এফটিপি সার্ভারে শেয়ার করতে, যাতে করে পৃথিবীর সবার জন্যই এর কোডটা উন্মুক্ত থাকে যাতে যে কেউ ইচ্ছে করলে সেটা নামিয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। সে “লিনাক্স” নামের একটি ফোল্ডারে এফটিপি সার্ভারে সেই কোডগুলো রেখে দিলেন। সেই থেকে নাম হয়ে গেল “লিনাক্স”। তাহলে এ্যারি লেমকের। এর মাথায় লিনাক্স নামটি কিভাবে আসল, সহজ ব্যাপার “Linus’s Unix” থেকেই এ্যারির মাথায় লিনাক্স নামটা চলে আসে। আসল নাম হারিয়ে লিনাক্স এখন যে নামে পরিচিত সেটা আসলে তার ডাউনলোড করার জন্য রাখা ফোল্ডারের নাম।
No comments:
Post a Comment